ড্রাইভিং লাইসেন্সে নতুন ভোগান্তি
বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়- এ অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার যোগ হলো নতুন এক ভোগান্তি। সব পরীক্ষা শেষে আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয় বিভিন্ন কাগজপত্র। এসব কাগজপত্রের কোনো একটিতে সামান্য ভুল হলেই আবেদনপত্র নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে আবেদনকারী পাচ্ছেন না ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স স্লিপ’। ফলে মূল লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে বায়োমেট্রিক তথ্য দেওয়ার দিনক্ষণ- সবই অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে প্রাথমিক করণীয় হলো শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা। এ আবেদন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হওয়ার তিন মাস পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে লিখিত ও মৌখিকের পাশাপাশি দিতে হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা।
প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর নতুন একটি আবেদন ফরম পুনরায় প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হয়। ফরমটির সঙ্গে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে নেওয়া চিকিৎসা সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি ও নির্ধারিত ফি জমার রশিদ বিআরটিএ কার্যালয়ে জমা দিতে হয়।
এসব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর আবেদনকারীকে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স স্লিপ সরবরাহ করে বিআরটিএ। এতে বায়োমেট্রিক তথ্য (ডিজিটাল ছবি, সই ও আঙ্গুলের ছাপ) দেওয়ার তারিখও উল্লেখ করা থাকে। বায়োমেট্রিক তথ্য দেওয়ার দিন আবেদনকারী শেষবারের মতো সব তথ্য সঠিক কি না, তা যাচাই করার সুযোগ পান। কিন্তু কাগজপত্রে ভুল হলে বায়োমেট্রিক পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ নেই।
আগে ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স স্লিপ’ হাতে লেখা হলেও এখন কম্পিউটারাইজড (ডিজিটালাইজড) করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো আবেদন, মানি রিসিপ্টের মতো কাগজে তথ্যের অতি সামান্য ভুল হলেই ভোগান্তির শিকার হতে হয় আবেদনকারীকে। বানানে সামান্য গরমিল থাকলেই কম্পিউটারে থাকা সফটওয়ার তথ্য নিচ্ছে না। এর মধ্যে রয়েছে স্পেস, ডট ও ড্যাশ থাকা না থাকার মতো ভুল। এক্ষেত্রে আবেদনপত্রও নিতে পারছে না বিআরটিএ। আবেদনকারীকে কয়েকদিন পর যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে বিআরটিএ কার্যালয় থেকে। ফলে ড্রাইভিং লাইসেন্স স্লিপ মিলছে না।
এ রকম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এমন একজন মো. মামুন হৃদয় (ছদ্ম নাম)। চলতি বছরের জুন মাসে শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন তিনি। ওই আবেদনে তার পরীক্ষার তারিখ পড়ে সেপ্টেম্বর মাসে। সবকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিয়ম অনুযায়ী আবারও আবেদনপত্র পূরণ করেন তিনি। তারপর ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি জমা দেন। ফি জমা দেওয়ার রশিদ (মানি রিসিপ্ট), নতুন আবেদনপত্রসহ সব কাগজপত্র নিয়ে তিনি মিরপুরে বিআরটিএ ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের ১১৫ নম্বর কক্ষে জমা দিতে যান।
কাউন্টারে দায়িত্বরত বিআরটিএ কর্মী মামুন হৃদয়কে জানান তার অন্যসব কাগজে থাকা নামের সঙ্গে মানি রিসিপ্টে থাকা নামের মিল নেই। কারণ, মানি রিসিপ্টে লেখা রয়েছে ‘মো মামুন হৃদয়’। এখানে ডট বাদ পড়েছে (.)। তাই আবেদনপত্রটি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাকে কয়েকদিন পরে আবারও কার্যালয়ে আসতে বলেন ওই কর্মী। তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স স্লিপ পাননি।
মামুন হৃদয় বলেন, আমি মেনে নিলাম যে, টাকা জমা দেওয়ার সময় ভুলবশত ডট (.) বাদ পড়েছে। বাকি সব তথ্য তো ঠিক আছে। তাহলে কেন আবেদন জমা নেবে না বিআরটিএ। দুই মাস পরে তো আমার স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার কথা। সেখানে তারা আবেদনই জমা নিল না। অনেক সময় তো ব্যাংকে যিনি টাকা জমা নেন, তিনিও নামের বানান লিখতে ভুল করেন। তাহলে সেই দায়ও কি আমার? কাউন্টারের লোক আমাকে জানালেন, এই প্রক্রিয়াটি নতুন। এখন ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। তাই সফটওয়ারে মিলছে না বলে জমা নেওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি আমি ডিজিটাল ভোগান্তিতে পড়লাম?
মামুন হৃদয়ের মতো ভোগান্তিতে পড়া এমন অন্তত ১০ জনের তথ্য রয়েছে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের হাতে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমনিতেই বিআরটিএতে ভোগান্তির শেষ নেই। তার ওপর শুরু হয়েছে নতুন ডিজিটাল ভোগান্তি। এই ভোগান্তি থেকে কবে রেহাই মিলবে জানা নেই। কবে পাওয়া যাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স ডেলিভারি স্লিপ, আর কবে পাওয়া যাবে লাইসেন্স, সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছে না কেউ।
আবেদনপত্র, মানি রিসিপ্ট বা অন্য কোনো কাগজের তথ্যে ডাবল স্পেস পড়া বা ডট-ড্যাশ না পড়ার মতো যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রেও ছাড় পাচ্ছেন না লাইসেন্স আবেদনকারীরা। মূলত কম্পিউটারের সফটওয়্যার সিস্টেম জটিলতাটি তৈরি করছে। আর এ সমস্যার কথা স্বীকার করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষও। তারা বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কোনো কারণে যদি আবেদনকারীর মানি রিসিপ্টে বা অন্য কোনো কাগজে থাকা নাম বা কোনো তথ্যের বানানে একটি স্পেস বেশি পড়ে বা ফুলস্টপ না থাকে, তবে আবেদনটি তার নামের বা ওই তথ্যের বিপরীতে আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এ বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে একটি অভিযোগ দিয়েছি এবং এটি সমাধানের জন্য কাজ চলছে। এটি যদি সমাধান হয়ে যায়, তখন আমরা প্রসেসিংয়ে যেতে পারব।
তিনি বলেন, আমরা সরাসরি কাজটি করি না। এটি থার্ড পার্টির মাধ্যমে করা হয়। আমরা একটি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করিয়ে নিই। ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানকে আমরা ইতোমধ্যে বলে দিয়েছি। তারা আমাদের কাছে ১০-১৫ দিন সময় চেয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বিআরটিএর নিবন্ধন এ বছর থেকেই শুরু হয়েছে। আসলে একজন আবেদনকারীর একটি ভুল হতেই পারে, একটি স্পেস বা ডট কম-বেশি পড়তেই পারে বা নাও থাকতে পারে। আর এর জন্য যদি পুনরায় টাকা জমা দিতে হয়, তাহলে তা আবেদনকারীর জন্য খুবই পেইনফুল হবে। তাই একটি মিটিংয়ে আলোচনা করে এর সমাধান করতে বলা হয়েছে।