ওমরাহ পালনের নিয়ম
ওমরাহ শব্দের অর্থ জিয়ারত করা, পরিদর্শন করা ও সাক্ষাৎ করা। পবিত্র কাবাগৃহের জিয়ারতই মূলত ওমরাহ। ইসলামের ভাষায় পবিত্র হজের সময় ছাড়া অন্য যেকোনো সময়ে পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফসহ নির্দিষ্ট কিছু কাজ করাকে ওমরাহ বলা হয়।
আবশ্যকীয় কাজ : ওমরাহ পালনে প্রধানত চারটি কাজ।
দুটি কাজ ফরজ—ইহরাম পরিধান করা এবং পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা।আর দুটি কাজ ওয়াজিব—সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সায়ি করা এবং মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা।
ইহরাম বাঁধার নিয়ম : ইহরাম পরিধানের আগে বেশ কিছু করণীয় আছে। তা হলো ইহরাম পরিধানের আগে সব ধরনের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে; যেমন—হাত পায়ের নখ কাটা, গোঁফ, চুল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি। ইহরাম পরিধানের আগে ফরজ গোসলের মতো গোসল করা সুন্নত।
এরপর পুরুষদের সেলাইবিহীন পোশাক এবং নারীদের যেকোনো উপযুক্ত পোশাক পরিধানের মাধ্যমে ইহরাম পরিধান করতে হবে। মিকাত (ইহরামের জন্য নির্দিষ্ট স্থান) বা তার আগে ওমরাহর নিয়ত করতে হবে। এরপর তালবিয়া পড়তে হবে। তারপর মাথায় বা দাড়িতে সুগন্ধি লাগাতে হবে। গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের পর ইহরামের কাপড় পরিধান করতে হবে। এরপর ফরজ নামাজের ওয়াক্ত হলে ফরজ নামাজ আদায় করতে হবে। ফরজ নামাজের ওয়াক্ত না হলে অজুর সুন্নত হিসেবে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে ইহরাম পরিধান করতে হবে। ইচ্ছা করলে বাহনে (গাড়িতে) উঠে যাত্রার প্রাক্কালে ইহরাম করতে পারেন। ইহরামের নিয়তে এই দোয়া পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল ওমরতা ফা-ইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি। ’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর ইচ্ছা করছি, আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন। ’
এরপর বলতে হবে : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা ওমরতান/ওমরাহ (অর্থ : হে আল্লাহ! ওমরাহকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)।
তালবিয়া পাঠের নিয়ম : এরপর নবী (সা.) যেভাবে তালবিয়া পড়েছেন সেভাবে তালবিয়া পড়তে হবে। সেই তালবিয়া হচ্ছে : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক। ’
পুরুষরা উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়বেন। ওমরাহর ক্ষেত্রে ইহরামের শুরু থেকে তাওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়ার বিধান আছে। তাওয়াফ শুরু করলে তালবিয়া পড়া ছেড়ে দেবেন।
নিষিদ্ধ কাজ : ইহরাম পরিধানের পর কিছু কাজ নিষিদ্ধ; যেমন—সেলাইযুক্ত কাপড় বা জুতা ব্যবহার নিষিদ্ধ। অনুরূপ মস্তক ও মুখমণ্ডল ঢাকা, চুল কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা, নখ কাটা, ঘ্রাণযুক্ত তেল বা আতর লাগানো, স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা, যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ বা কোনো কথা বলা, শিকার করা, ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ করা, চুল-দাড়িতে চিরুনি বা আঙুল চালনা করা যাতে ছেঁড়ার আশঙ্কা থাকে, শরীরে সাবান লাগানো, উকুন, ছারপোকা, মশা-মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা, যেকোনো ধরনের গুনাহর কাজ করা।
তাওয়াফের নিয়ম : পবিত্র কাবাগৃহ সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। ওমরাহর উদ্দেশ্যে মসজিদে হারামে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করে এই দোয়া পড়া : ‘বিসমিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ। আউজু বিল্লাহিল আজিম ওয়া বি-ওয়াজহিহিল কারিম ওয়া সুলতানিহিল কাদিমি মিনাশ শায়ত্বনির রাজিম। আল্লাহুম্মাফ তাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা। ’
এরপর তাওয়াফ শুরু করার জন্য হাজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাবেন। ডান হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবেন এবং চুমু খাবেন। যদি হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারেন, হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন এবং হাতে চুমু খাবেন। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারেন তাহলে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত দিয়ে ইশারা করবেন এবং তাকবির বলবেন। কিন্তু হাতে চুমু খাবেন না।
এরপর ডান দিক ধরে চলতে থাকবেন। বাইতুল্লাহকে বাঁ দিকে রাখবেন। যখন রুকনে ইয়ামানিতে (হাজরে আসওয়াদের পর তৃতীয় কর্নার) পৌঁছবেন তখন সেই কর্নার চুমু খাবেন এবং তাকবির ছাড়া শুধু স্পর্শ করবেন। যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে তাওয়াফ চালিয়ে যাবেন; ভিড় করবেন না।
তাওয়াফের সময় কাবা শরিফ ও হাজরে আসওয়াদকে বাঁ দিকে রেখে রুকনে শামি ও রুকনে ইরাকি অতিক্রম করে রুকনে ইয়ামানিতে আসবেন। এই স্থানে তালবিয়া, তাকবির, তাসবিহ ইত্যাদি পড়বেন। অতঃপর (সম্ভব হলে) রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করবেন। সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে হাজরে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হবেন এবং কোরআনে শেখানো এই দোয়া পড়বেন : ‘রব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আজাবান নার। ’
যখনই হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবেন, তখন হাজরে আসওয়াদ অভিমুখী হয়ে তাকবির বলবেন। তাওয়াফের অন্য অংশে যা কিছু খুশি—জিকির, দোয়া ও কোরআন তিলাওয়াত করবেন।
পুরুষের তাওয়াফ ভিন্ন যেখানে : তাওয়াফের মধ্যে পুরুষকে দুটি জিনিস করতে হয়। তা হলো—
১. তাওয়াফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইজতেবা করা। ইজতেবা মানে ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের মাঝের অংশ বগলের নিচ দিয়ে এনে চাদরের পার্শ্ব বাঁ কাঁধের ওপর ফেলে দেওয়া। তাওয়াফ শেষ করার পর চাদর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেবেন। কারণ ইজতেবা শুধু তাওয়াফের মধ্যে করতে হয়।
২. তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। রমল মানে ছোট ছোট পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটা। আর বাকি চার চক্করে রমল নেই বিধায় স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করার পর ডান কাঁধ ঢেকে নিয়ে মাকামে ইবরাহিমে আসবেন এবং পড়বেন ‘ওয়াত্তাখিযু মিম মাকামি ইবরাহিমা মুসল্লা। ’
তাওয়াফ শেষে যে নামাজ পড়তে হয় : অতঃপর মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন। প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা ইখলাস পড়বেন।
দুই রাকাত সালাত আদায় করার পর জমজমের পানি পান করবেন। মাতাফের (তাওয়াফ করার স্থান) চারদিকে জমজমের গরম ও ঠাণ্ডা পানির ঝার/ড্রাম আছে। জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করবেন এবং পান করার সময় বলবেন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি’আ, ওয়ারিযক্বাও ওয়াসি’আ, ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দা’ঈ’। (হে আল্লাহ! আমাকে উপকারী জ্ঞান দান করুন! পর্যাপ্ত রিজিক দান করুন! সব রোগের শিফা দান করুন)।
সায়ি করার নিয়ম : সাফা-মারওয়ায় সায়ি করার নিয়ম হলো, জমজমের পানি পান করে ধীরে ধীরে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করবেন। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটি কাবা শরিফের পাশেই অবস্থিত। এরপর মাসআ (সায়ি করার স্থান) আসবে। যখন সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবেন তখন পড়বেন ‘ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ। ’
এই আয়াত শুধু সায়ির শুরুতে সাফার নিকটবর্তী হলে পড়বেন। সাফা-মারওয়ায় প্রতিবার আয়াতটি পড়বেন না। এরপর বলবেন ‘নাবদাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি। ’ (অর্থ : আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমরাও তা দিয়ে শুরু করছি)।
অতঃপর সাফা পাহাড়ে উঠবেন, যাতে কাবা শরিফ দেখতে পান। কাবার দিকে ফিরে ‘আলহামদু লিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলবেন। কাবা নজরে এলে কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করবেন। নবী (সা.)-এর দোয়ার মধ্যে ছিল—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহ, আনজাযা ওয়াদাহ, ওয়া নাসারা আবদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদা। ’
এই জিকিরটি তিনবার উচ্চারণ করবেন এবং এর মধ্যে দোয়া করবেন। একবার এই জিকির বলবেন। এরপর দোয়া করবেন। দ্বিতীয়বার জিকিরটি বলবেন এবং এরপর দোয়া করবেন। তৃতীয়বার জিকিরটি বলে মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন। তৃতীয়বারে আর দোয়া করবেন না। যখন সবুজ রং চিহ্নিত স্থানে পৌঁছবেন তখন যত জোরে সম্ভব দৌড়াবেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দেবেন না। দ্বিতীয় সবুজ রং চিহ্নিত স্থান থেকে স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। এভাবে মারওয়ায় পৌঁছবেন। সবুজ চিহ্নিত স্থানে এই দোয়া পড়বেন : ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ-আযযুল আকরাম। ’
সবুজ চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করে নারী-পুরুষ সবাই স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। মারওয়ার ওপর উঠে কিবলামুখী হয়ে হাত তুলে দোয়া করবেন। সাফা পাহাড়ের ওপর যা যা পড়েছেন ও বলেছেন এখানেও তা তা পড়বেন ও বলবেন। এরপর মারওয়া থেকে নেমে সাফার উদ্দেশে হেঁটে যাবেন। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার স্থানে হেঁটে পার হবেন আর দৌড়ানোর স্থানে দৌড়ে পার হবেন। সাফায় পৌঁছার পর আগে যা যা করেছেন তা তা করবেন। মারওয়ার ওপরও আগের মতো তা তা করবেন। এভাবে সাত চক্কর শেষ করবেন। সাফা থেকে মারওয়া গেলে এক চক্কর। মারওয়া থেকে সাফায় এলে এক চক্কর। সায়ির মধ্যে যা খুশি জিকির, দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন।
সায়ি শেষ হলে এই দোয়া পড়বেন : ‘রব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস ছামিউল আলিম। ’
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা : সাত চক্কর সায়ি শেষ করার পর পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা মাথার চুল ছোট করবেন। মুণ্ডন করলে মাথার সর্বাংশের চুল মুণ্ডন করতে হবে। অনুরূপভাবে চুল ছোট করলে মাথার সর্বাংশের চুল ছোট করতে হবে। মাথা মুণ্ডন করা চুল ছোট করার চেয়ে উত্তম। নারীরা আঙুলের এক কর পরিমাণ মাথার চুল কাটবেন। এই আমলগুলোর মাধ্যমে ওমরাহ সমাপ্ত হবে। সুতরাং ওমরাহ মূলত ইহরাম, তাওয়াফ, সায়ি, মাথা মুণ্ডন বা মাথার চুল ছোট করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।