মার্কিন হামলা ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত ভেনেজুয়েলা?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৫২ এএম
যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই হামলা করে, তবে তা মোকাবিলার সক্ষমতা কতটুকু আছে ভেনেজুয়েলার? তারা কি পারবে তাদের বিশাল তেল-সম্পদ ও জনগণকে মার্কিন হামলা থেকে রক্ষা করতে? বিগত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে ঘুরে বেড়াছে এসব প্রশ্ন।
ভেনেজুয়েলা সরকার তাদের উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় তারা দেশব্যাপী সামরিক বাহিনী মোতায়েন শুরু করেছে। পশ্চিম গোলার্ধে তথাকথিত ‘মাদক-সন্ত্রাসীদের’ দমন করার লক্ষ্যে গত বৃহষ্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘সাউদার্ন স্পিয়ার’ নামের এক অভিযান ঘোষণা দেয়ার পরপর ভেনেজুয়েলা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। চলমান এই উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে ভেনেজুলায়। দেশটির কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অজুহাত হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র এসব সামরিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা বা আগ্রাসন সামাল দিতে ভেনেজুয়েলা সত্যিই কতটা প্রস্তুত? তাদের সামরিক সামর্থ্য কতটা? এবং এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিকোলাস মাদুরোর রাজনৈতিক হিসাব কী?
কী ঘটছে সাম্প্রতিক সময়ে?
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে ওয়াশিংটন–কারাকাসের মধ্যবর্তি উত্তেজনা নিয়মিত বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ক্যারিবীয় সাগর ও পরে প্রশান্ত মহাসাগরে পথ ব্যবহার করে মাদক পাচারিকারীরা আমেরিকায় মাদক পাচার করে। তাদের অভিযোগ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এই মাদক পাচারের সাথে জড়িত। এই নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই ভেনেজুইয়েলা সরকারের সমালোচনা করার পাশাপাশি নিকোলাস মাদুরোকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে মার্কিন প্রশাসন। এই ধারাবাহীকতায় সম্প্রতি ভেনেজুয়েলা ও তার আশেপাশের দেশের আকাশসীমাও বন্ধ ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত না বললেও শনিবার এমন এক সময়ে তার এ মন্তব্য এসেছে, যখন ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়িয়েই চলছে। ট্রাম্প এর আগে বারবারই ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে কথিত মাদকবাহী নৌযানের ওপর হামলা চালানোর কথা জানিয়েছেন। এদিকে ভেনেজুয়েলা ও দেশটির আশপাশের আকাশসীমা ‘সম্পূর্ণ বন্ধ’ বিবেচিত হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কারাকাস। দুই দেশের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। গতকাল শনিবার বিকেলে এক বিবৃতিতে ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ট্রাম্পের করা ওই মন্তব্য ‘ঔপনিবেশিক হুমকি’র শামিল।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, নৌযানে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে স্থল হামলায় গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ উত্তেজনার মধ্যেই দিনকয়েক আগে ট্রাম্পের সঙ্গে মাদুরোর ফোনালাপ এবং সামনেই ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে পারেন বলে খবরও ছড়িয়েছে।
এদিকে চলতি সপ্তাহেই মাদক বিরোধি এই অভিযানের ২০টিরও বেশী হামলা করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এসব হামলায় এখনো পর্যন্ত অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছে। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, মাদুরো নাকি মাদক কারবারিরদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার করছেন।
তবে কোনো নৌকায় মাদক ছিল বা সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল, এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন প্রসাশন। হামলার কোনো আইনি ভিত্তি দেখাতে না পারায় এইসব হামলা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলা উপকূলে শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পাঠিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ও সহায়ক জাহাজ। চার হাজারের বেশি সেনা এবং অগণিত ট্যাকটিক্যাল বিমানের সমন্বয়ে এটি একটি অত্যাধুনিক নৌবহর।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, তাদের লক্ষ্য ঘোষিত উদ্দেশ্যের চেয়েও বিস্তৃত।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, ফোর্ড মূলত সমুদ্রে বা স্থলে শত্রুর বিরুদ্ধে বড় আকারের আক্রমণের জন্য উপযুক্ত। মাদকবিরোধী অভিযানে এটি আদর্শ নয়।
তিনি আরও বলেন, এই মোতায়েন স্থায়ী হতে পারে না। বিশ্বের নানা অঞ্চলে এমন শক্তিশালী জাহাজের চাহিদা রয়েছে।
ভেনেজুয়েলা কি প্রস্তুত?
ভেনেজুয়েলা সরকার বলেছে, সম্ভাব্য মার্কিন হামলার মুখে তারা বৃহৎ পরিসরের সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী মোতায়েন শুরু করেছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ জানান, যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা জোরদারের করতে ‘ইনডিপেনডেন্স প্ল্যান ২০০’ সক্রিয় করা হয়েছে। প্রায় দুই লাখ সেনা জাতীয় ভূখণ্ডে মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, দেশটির সামরিক বাহিনী ঐক্যবদ্ধ এবং ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ভেনেজুয়েলার ওপর কোনো আগ্রাসন সমর্থন করে না।
বিশ্লেষকদের মতে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘শ্যাভিজমো’ মতাদর্শের অধীনে গড়ে ওঠা ভেনেজুয়েলার সামরিক প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন খুবই দৃঢ়। এতে তারা সহজে ভাঙবে না।
ভেনেজুয়েলার সামরিক সক্ষমতা কেমন?
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে সামরিক শক্তিতে বিশ্বের ১৬০ দেশের মধ্যে ভেনেজুয়েলার অবস্থান ৫০তম। লাতিন আমেরিকায় তাদের অবস্থান সপ্তম।
সিএসআইএস’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার বিমানবাহিনী ছোট এবং আংশিকভাবে কার্যকর। তাদের ৪৯টি বিমানের মধ্যে প্রায় ৩০টি সচল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে মাত্র তিনটি এফ-১৬ উড়তে সক্ষম। অন্যদিকে রাশিয়ার নির্মিত এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান ভেনেজুয়েলার প্রধান শক্তি। এগুলোর অন্তত ২১টি সচল রয়েছে, যা আল্ট্রাসনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বহনে সক্ষম।
যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই ভেনেজুয়েলার বিমানঘাঁটি ও বিমান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে অঞ্চলটিতে এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার মোতায়েন করেছে।
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের মতে, ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীতে ৩ লাখ ৩৭ হাজার সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৯ হাজার সক্রিয় সদস্য, ২ লাখ ২০ হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বাকি আট হাজার রিজার্ভ কর্মী।
তবে ভেনেজুয়েলার জনবল বেশি হলেও বছরের পর বছর যুদ্ধ–প্রশিক্ষণের অভাব ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেন্দ্রিক বাহিনীতে রূপান্তর বড় দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারে।
দেশটির নৌবাহিনীও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় খুবই দুর্বল। সার্বিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সঙ্গে ভেনেজুয়েলার তুলনা চলে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।
তবে স্থানীয় প্রতিরোধ ও গেরিলা–ধরনের লড়াইয়ের সম্ভাবনা বাস্তবিক উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। অরিনোকো রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস ফেরর বলেন, ‘যদি সংঘাত হয়, ভেনেজুয়েলা দেশটিকে পরিচালনার অযোগ্য করে তুলতে পারে—এটাই অসম যুদ্ধের কৌশল।”
যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই হামলা করবে?
ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, মাদকপ্রবাহ ঠেকাতেই সামরিক তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য মাদুরোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ভেনেজুয়েলায় অনুপ্রবেশ চান না। অনেক বিশেষজ্ঞের মত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশল এখনো রাজনৈতিক, সামরিক নয়।
ভেনেজুয়েলার বিশ্লেষক কার্লোস পিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য মাদুরোকে চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা। সরাসরি আক্রমণ সবচেয়ে কম পছন্দনীয় বিকল্প। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এত বড় সামরিক উপস্থিতি দেখানোর পর যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটলে তা ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হবে, ফলে চাপ কমানোর বদলে তারা আরও বাড়াতে পারে।