রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান। মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য প্রথমে স্থানীয় কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে ফিরে আসেন। সেখানে তাকে বলা হয়, জন্মনিবন্ধন সেবা নিতে তাকে যেতে হবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে। কারণ, তার এলাকা অনুযায়ী এ সেবা ডিএনসিসির ৯ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ের (মহাখালী) অধীন। সেখানে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন সার্ভার ডাউন থাকায় এ মুহূর্তে তারা সেবাটি দিতে পারছেন না।
প্রায় এক মাস ধরে সেবাটি পাওয়ার জন্য বারবার মহাখালী আসা-যাওয়া করছেন মোখলেছুর রহমান। তিনি জানান, মেয়ের স্কুলে জন্মনিবন্ধন সনদ লাগবে জরুরিভাবে। তাই প্রথমে কাউন্সিলর কার্যালয়ে যাই। পরে সেখান থেকে মহাখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে ঘুরে আসি কয়েকবার। আমাকে বলা হয়, তারা সার্ভার পাচ্ছে না। যে কারণে সেবাটি আপাতত বন্ধ। প্রায় মাসখানেক ঘুরে জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে পারিনি। পরে যখন আবার গেলাম তখন বলা হলো, সন্তানের জন্মনিবন্ধন নতুন করে করাতে হলে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন থাকতে হবে অনলাইনে। আমাদের জন্ম নিবন্ধন ছিল ১৭ ডিজিটের। ওই সময় অনলাইন ছিল না।
‘আমাদের জন্মনিবন্ধন ঠিক করাতে চলে গেলাম নিজ জেলায়। কিন্তু অনেক আগের জন্মনিবন্ধন বলে সেখান থেকে ঠিক করানো সম্ভব হয়নি। ঢাকায় ফিরে এসে আবার সেই আঞ্চলিক কার্যালয়ে গেলাম। ততদিনে সার্ভার ঠিক হয়েছে। একজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম কিছু টাকা খরচ করলে দালালরা জন্মনিবন্ধন করার ভোগান্তি কমিয়ে দিতে পারেন। সেই অনুযায়ী মহাখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের আশেপাশে থাকা এক দালালের শরণাপন্ন হলাম। দুই হাজার টাকার বিনিময়ে খুব সহজে তিনি মেয়ের জন্মনিবন্ধন বের করে দিলেন।’
তবে, সার্ভার ডাউন থাকলে দালাল ধরেও জন্মনিবন্ধন বের করা সম্ভব না। মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ করাতে গিয়ে আমি বুঝেছি এটা কত ভোগান্তির কাজ। প্রতিদিন শত শত মানুষ ঘুরছে, কিন্তু সার্ভার ডাউন থাকায় তারা বারবার ফিরে যাচ্ছেন— বলেন মোখলেছুর রহমান।
ভোগান্তির ভিন্ন কথা জানালেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা রুবেল আহমেদ। কয়েক বছর আগে ছেলের জন্মনিবন্ধন করিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কারওয়ান বাজার অঞ্চল- ১০ এর কার্যালয় থেকে। বাড্ডার বাসিন্দা হওয়ায় তার জন্মনিবন্ধন সেবা কারওয়ান বাজার আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে ছেলের নামের একটি বানান অসাবধানতাবশত ভুল হয়ে যায়। পড়েন মহাভোগান্তিতে।
রুবেল আহমেদ জানান, প্রথমে নামের বানান সংশোধনের জন্য আমি কাউন্সিলর কার্যালয়ে যাই। সেখান থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে যাই ডিএনসিসির কারওয়ান বাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ে। আমাকে বলা হয়, সংশোধনীর কোনো কাজ নির্দিষ্ট সময়ের পরে তারা আর করতে পারেন না। যেতে হবে সদরঘাটে অবস্থিত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে গিয়ে জানতে পারি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রথমে ইনপুট দিতে হবে। পরে আঞ্চলিক কার্যালয়ে ফিরে আসি। তারা বলে, অনলাইনে আগে ফরম পূরণ করে আসতে হবে। অনলাইনে ফরম পূরণ করে আসার পর আঞ্চলিক অফিস বলে, তারা সার্ভারে তথ্য পাচ্ছে না। এভাবে কয়েক মাস ঘুরে অবশেষে ছেলের জন্মনিবন্ধন সনদের নাম সংশোধন করতে পেরেছি।
‘জন্মনিবন্ধনের জন্য দিনের পর দিন একবার কাউন্সিলর কার্যালয়, একবার অনলাইন দোকান, একবার আঞ্চলিক কার্যালয় আবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ঘুরে ঘুরে বুঝেছি এটা কত বড় ভোগান্তির কাজ। শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সবাইকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। যারা এটা ফেস করেছে তারাই বুঝতে পারবে। হয় এ সেবা আরও সহজ করতে হবে, না হয় ভিন্ন পথ বেছে নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের’— বলেন ভুক্তভোগী রুবেল আহমেদ।
মোখলেছুর রহমান কিংবা রুবেল আহমেদ শুধু নন, অসংখ্য মানুষ জন্মনিবন্ধন এবং তা সংশোধন করাতে গিয়ে প্রতিদিন সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়ছেন। এ সেবা খাতে নতুন দুর্ভোগ হিসেবে যোগ হয়েছে সার্ভার না থাকা। কাউন্সিলর কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয় আবার জেলা প্রশাসক কার্যালয় ঘুরে ঘুরে বিরক্ত মানুষ।
তবে, আশার কথা হলো এ সেবা সহজ করতে উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। নতুন উদ্যোগ অনুযায়ী জন্মনিবন্ধনের জন্য সাধারণ মানুষকে আর দূর-দূরান্তের আঞ্চলিক কার্যালয়ে যেতে হবে না। স্থানীয় কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এটা সংগ্রহ করা যাবে। সেক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হবেন নিবন্ধক এবং কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব হবেন সহকারী নিবন্ধক। এছাড়া নাম বা তথ্য সংশোধনের জন্য আগামীতে আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে না গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে সেবা নেওয়া যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মানুষের ভোগান্তি দূর করতে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে এবং যেকোনো সংশোধনীর জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্থানান্তরের অনুরোধ জানানো হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্মতি দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য চেয়েছে সিটি কর্পোরেশনের কাছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই এ সেবা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে শুরু হবে। পাশাপাশি যেকোনো সংশোধনীজনিত সেবা সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাওয়া যাবে
স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র যদি চান তার ক্ষমতাবলে নিবন্ধকের দায়িত্ব কাউন্সিলরদের দিতে পারেন। এছাড়া সহকারী নিবন্ধক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ওয়ার্ড সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখিত সব তথ্য পূরণ করে পাঠানোর পর রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় এ বিষয়ে কাজ শুরু করবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক জানান, কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করেছে ডিএনসিসি। ১৫তম কর্পোরেশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ডিএনসিসির জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন সংক্রান্ত ১৩ সদস্যের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম গণি এবং অঞ্চল- ২ এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন- ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রউফ নান্নু, ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ন রশিদ, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৈমুর রেজা, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সেলিম, ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদ, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর নাজমুন নাহার হেলেন এবং ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর শাহিন আক্তার সাথী। এ কমিটি জন্মনিবন্ধন বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মাসুম গণি জানান, জন্মনিবন্ধন সেবায় ভোগান্তি দূর করতে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে করা আবেদনে পজিটিভ সম্মতি দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন এবং আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে সার্বিক সংশোধনী সেবা দিতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। প্রাথমিকভাবে পুরাতন ৩৬টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এ সেবা দেওয়া হবে। নতুন ১৮টি ওয়ার্ড কার্যালয়ে এ সেবা যেতে কিছুটা সময় লাগবে। পাশাপাশি ওয়ার্ড সচিব নিয়োগের কাজও শুরু হচ্ছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় থেকে যা জানানো হয়েছে
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রক্রিয়ার বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন- ২০০৪ এর আওতায় একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাবা ও মায়ের নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদানসহ ডেটাবেজে সংরক্ষণ এবং জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা মেয়র কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কাউন্সিলর বা অন্য কোনো কর্মকর্তা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং দূতাবাসগুলোর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করে থাকেন। একই ব্যক্তির অনুকূলে একাধিকবার জন্মনিবন্ধন করা যাবে না। এটা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন- ২০০৪ এর ২১ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয়। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করা থাকলে orgbdr.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে জন্ম তথ্য যাচাই অপশনে ব্যক্তির ব্যাপন নম্বর ও জন্মতারিখ প্রদান করে জন্মনিবন্ধন হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হয়। ১৭ ডিজিটের কম ব্যাপন নম্বর হলে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধকের কার্যালয়ে পুরাতন সনদ জমা দিয়ে ১৭ ডিজিট ব্যাপন নম্বর সম্বলিত সনদ নিতে হবে।
কোনো উদ্যোগ নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির
জন্মনিবন্ধন বা সংশোধনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এখনও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আগের মতো তাদের জন্মনিবন্ধন আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে করতে হবে। সেই সঙ্গে সংশোধনীর জন্য আগের মতো নাগরিকদের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যেতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা এখনও নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। আগের মতো আঞ্চলিক কার্যালয়ে এ সেবা প্রদান করা হবে। স্থানীয় কাউন্সিলর কার্যালয়ে এ সেবা স্থানান্তর করতে অনেক প্রক্রিয়ার বিষয় আছে। পরবর্তীতে এ বিষয় নিয়ে আমরা কাজ শুরু করব।
এদিকে, সার্ভার জটিলতায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সেবা বন্ধ রয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। ফলে সেবা নিতে আসা সেবাগ্রহীতারা ভোগান্তিতে পড়ছেন। কবে এটা ঠিক হবে তা স্পট করে বলতে পারছেন না আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর ২, মিরপুর ৪, উত্তরা ও মহাখালীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সার্ভার বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে তারা জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন করাতে পারছেন না।
‘ভোগান্তির শেষে নেই’— উল্লেখ করে ডিএনসিসির উত্তরা আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সেবা নিতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মিজানুর রহমান বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। কিন্তু ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে পারছি না। যখনই আসি তারা বলে সার্ভার নেই। অথচ একটা জরুরি কাজের জন্য ছেলের জন্মনিবন্ধন সনদের দরকার ছিল। এটা করতে যে এত ভোগান্তি এখানে না আসলে কখনই বুঝতাম না।
রাজধানীর মহাখালী আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে মেয়ের জন্মনিবন্ধন করিয়েছেন আবুল কালাম। ভোগান্তির বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, পদে পদে ভোগান্তি। প্রথমে বলা হলো বাবা ও মায়ের অনলাইন জন্মনিবন্ধন লাগবে। নানা ভোগান্তি পেরিয়ে তা করালাম কয়েক মাসে। এরপর বলা হলো অনলাইনে ফরম পূরণ করে আসেন। ফরম পূরণ করার পর গেলে তারা জানাল, সার্ভারে তথ্য নেই। পরে আবার ওই অনলাইনের দোকানে গেলাম। সেখান থেকে সব ঠিক করে আসার পর দেখা গেল কয়েকদিন তাদের সার্ভার নেই। মানুষ এসে এসে ঘুরে যাচ্ছে। পরে হোল্ডিং ট্যাক্স, বিদ্যুৎ বিলসহ নানা কাগজ চাওয়া হলো।
‘সব চাহিদা পূরণ করে দ্রুত জন্মনিবন্ধনের কাগজ পেতে দালালকে দিতে হলো ঘুষ। তারপর বলা হলো জন্মনিবন্ধনে যদি কোনো ভুল থাকে তাহলে এটা এখানে আর ঠিক করা যাবে না। যেতে হবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে।’
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সার্ভার না পাওয়া। প্রায় সময়ই এটা পাওয়া যায় না— বলেন ভুক্তভোগী আবুল কালাম।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির মহাখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের একজন সহকারী নিবন্ধক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জন্মনিবন্ধন করার কাজ আসলেই খুব ঝামেলার। এখানে নানা তথ্য লাগে। বাবা ও মায়ের জন্মনিবন্ধন অনলাইনে থাকতে হয়। আগের মানুষের কারোরই জন্মনিবন্ধনের তথ্য অনলাইনে নেই। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে এসে আগে বাবা ও মার অনলাইন জন্মনিবন্ধন করতে হয়। পরিপূর্ণ তথ্য দিতে হয়। যে কারণে ইনপুট দিতে অনেক সময় লেগে যায়।
এখন বাচ্চাদের সবকিছুতেই জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই বাবা-মারা প্রতিদিন আঞ্চলিক কার্যালয়ে ভিড় জমান। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মাঝে মাঝে সার্ভার থাকে না। আমাদেরও বসে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর অনেকে ফিরে যান সেবা না পেয়ে। এ সমস্যা সমাধানে প্রথমে সার্ভার ফ্রেন্ডলি করতে হবে এবং এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে— জানান ওই নিবন্ধক।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, জন্মনিবন্ধন বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে বেশিরভাগ সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন লাগে। কিন্তু এ সেবা পেতে সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়। যারা জন্মনিবন্ধন নিতে গেছেন তারাই শুধু এটা পাওয়ার দুর্ভোগ সম্পর্কে জানেন। তাই নাগরিক সেবা সহজীকরণে এটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাজ করা জরুরি।
‘জন্মনিবন্ধন বা ভোটার আইডি সংশোধন করতে গেলে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়। ভোগান্তিটা শুরু হয় এখান থেকে। আঞ্চলিক কার্যালয়ে অসাধুরা থাকে। তারা ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়। না দিলে বলা হয় ইলেকট্রিক বিলের কাগজ, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের কাগজ; এগুলো না থাকলে জমিজমার কাগজ চেয়ে হয়রানি করা হয়। যারা অসৎ পথ বেছে না নেন তাদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই।’
অথচ সরকারিভাবে বলা হয় অনলাইনে আবেদন করলেই হয়ে যাবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। অনলাইনে আবেদন করতে হলে একজন ব্যক্তি ফরম পূরণ করবেন, সেখানেই সব তথ্য দেবেন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, অনলাইনে ফরম পূরণের পর সেই ফরম প্রিন্ট করে কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়। প্রত্যয়নপত্র নিতেও নানা ঝামেলা। এসব হয়রানিমূলক কাজ বন্ধ করতে না পারলে নাগরিকদের ভোগান্তি শেষ হবে না— মনে করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।