জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা। তারা বলেছেন, এ সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে গেলে ভোটার তালিকা ও ইভিএমে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। মানুষের মধ্যে ভোটার হওয়ার আগ্রহও থাকবে না।
নির্বাচন ভবনে বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তারা এ পরামর্শ দেন। ওই বৈঠকে সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সচিবসহ ১৪ জন অংশ নেন।
ওই বৈঠকে প্রায় সব বক্তাই অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন বন্ধ করে ইসির দেওয়া সিদ্ধান্তকে সঠিক ছিল বলে মন্তব্য করেন। এ ধারা অব্যাহত রেখে নির্বাচনে অনিয়ম হলে প্রয়োজনে বার বার ভোট বন্ধ করার সুপারিশ করেন। তবে ইসির সাবেক একজন সচিব ওই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। এ ছাড়া বেশিরভাগ বক্তা জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশনের হাতেই থাকার ওপর জোর দেন।
তারা বলেন, এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকা ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া জড়িত। এটি সরকারের হাতে গেলে গণ্ডগোল সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বৈঠকে ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা নিয়েও আলোচনা হয়। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সাবেক সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে ভিন্ন মত উঠে আসে। তবে ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের ওপর জোর দেন তারা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে তিন ঘণ্টা এ বৈঠক চলে। বৈঠকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রউফ, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কেএম নূরুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন, শাহ নেওয়াজ, রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম, সাবেক ইসি সচিব এমএ রেজা, সচিব মুহম্মদ সাদিক, সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও হেলালুদ্দীন আহমেদ, ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও মোখলেসুর রহমান অংশ নেন।
যদিও নির্বাচন কমিশন ২৯ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সূচনা বক্তব্যে সিইসি গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন বন্ধে ইসির সিদ্ধান্তের বিষয়ে সাবেকদের মতামত জানতে চান। একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ, সব দলের অংশগ্রহণ এবং এসব ক্ষেত্রে আইন সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না- সে বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
বৈঠকে এনআইডি সেবা নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা।
সভা শেষে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আব্দুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিভিন্ন কার্যালয়ে থাকতে পারে। এতে অসুবিধা নেই। এটা ইসির কাছে না থাকলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যদি দেখেন এনআইডিতে একটি, ভোটার তালিকায় অন্যটা, তখন সমস্যা সৃষ্টি হবে।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেন, ভোটার তালিকা থেকেই এনআইডি এসেছে। এটা ইসির কাছে থাকা উচিত। এনআইডি ইসির কাছে না থাকলে লোকজন ভোটার হতে চাইবে না। মানুষের ভোটার হওয়ার অতটা আগ্রহ নেই। এখন এনআইডির জন্যই আগ্রহ বেশি। তিনি মনে করেন, এনআইডিতে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে ঠিক করা যেতে পারে। এটাকে আরও মজবুত করা উচিত।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেন, এনআইডি নির্বাচন কমিশনের তৈরি। এটা ইসির হাতে থাকলে সরকারের কোনো অসুবিধা হয় না। এনআইডির সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন, ভোটার তালিকার পুরোপুরি সম্পর্ক রয়েছে। এটাকে মাঝখান থেকে নিয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের কাজ করতে অসুবিধা হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এনআইডি সরকার কেন নিতে চাইছে- সেটা পরিষ্কার নয়। এতগুলো বছরে একটি সিস্টেম দাঁড়িয়েছে। এটা যদি আলাদা হয়, ভবিষ্যতে ভোটার তালিকা নিয়ে কথা উঠবে।
পরে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, এনআইডি সেবা ইসির হাতে থাকা প্রয়োজন- একবাক্যে সবাই এ কথা বলেছেন।
প্রসঙ্গত, জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সেবা ও সব ধরনের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। গত ১০ অক্টোবর ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন আইন, ২০২২’ এর খসড়া শর্তসাপেক্ষে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। একইসঙ্গে ওই খসড়া আইনে আবারও সংশোধনী আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ খসড়া সংশোধনী ২০১০ সালের আইনের আদলে করতে বলা হয়। এতে কমবেশি ৩২টি ধারা থাকবে।
এ আইন পাশ হলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের কাছে চলে যাবে। তখন জন্মের পর থেকেই শিশুদের এনআইডি দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন সুরক্ষা বিভাগের ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করতে পারবে অথবা নিজেরাও পৃথকভাবে ভোটার তালিকা করতে পারবে। তবে আইনটি পাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকবে।