কালো পোপা বা কালো পোয়া একটি সামুদ্রিক মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম প্রোটোনিবিয়া ডায়াকানথুস (protonibea diacanthus)। ইংরেজি নাম ব্ল্যাকস্পটেড ক্রোকার (blackspotted croaker)। এটি মূলত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পাওয়া যায়।
অন্যান্য মাছের মতো দেখতে হলেও কালো পোপাকে ‘সমুদ্রের সোনা’ বলা হয়। যা মূলত এর বায়ুথলি বা পটকার (Swim bladder/air bladder) জন্য। মাছটি বাংলাদেশ উপকূলের সেন্ট মার্টিন চ্যানেলে পাওয়া যায়।
ভারতের পশ্চিম উপকূলে শীত মৌসুমে এই মাছ জেলেদের জালে বেশি ধরা পড়ে। এর চামড়া থেকে জেলাটিন তৈরি করা হয় এবং বায়ুথলি অনেক চড়া দামে বিক্রি হয়। এর বায়ুথলি সাধারণত হংকং, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হয়, যা থেকে বিশেষ ধরনের সার্জিক্যাল সুতা ও আইসিনগ্লাস (isinglass) তৈরি করা হয়। তবে পুরুষ মাছের বায়ুথলির দাম স্ত্রী মাছের তুলনায় বেশি। এ জন্যই কালো পোপাকে সি গোল্ড বা সমুদ্রের সোনা বলা হয়। এই মাছ সর্বোচ্চ ১.৫ মিটার লম্বা ও ওজনে ৪৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
বুধবার (১৬ নভেম্বর) বিকেলে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন ও অধ্যাপক ড. দেবাশীষ সাহা এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান।
ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আমাদের দেশের মানুষকে বলা হয় মাছে ভাতে বাঙালি। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত মাছের মাংসের অংশটুকু খেয়ে থাকে। বায়ুথলি, চামড়াসহ অন্যান্য উচ্ছিষ্ট অংশ থেকেও মূল্যবান অনেক কিছু তৈরি করা হয়। ইদানিং মাছের আঁশ, পাখনা ও বায়ুথলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কালো পোয়া ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পাওয়া যায়। আমাদের জেলেরা কম পেয়ে থাকে এবং পেলে খুব হইচই পড়ে যায়। মূলত এর বায়ুথলির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই জেলেরা একে সি গোল্ড বা সামুদ্রিক সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করে। জেলেদের আকাঙ্ক্ষাই থাকে তাদের জালে যেন কালো পোয়া ধরা পড়ে।
মাছটির বিষয়ে অধিক গবেষণার প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের জেলেরা বড় বড় কালো পোয়া পাচ্ছেন, তাই দেখতে হবে এর পোনা বা ছোট পোয়া সংরক্ষণ করা যায় কিনা। তাহলে আমাদের ব্লু ইকোনমির যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগাতে পারব।
অধ্যাপক ড. দেবাশীষ সাহা বলেন, কালো পোয়ার বায়ুথলি বা সুইম ব্লাডার দিয়ে এক ধরনের সার্জিক্যাল সুতা তৈরি করা হয়। সারাবিশ্বে সার্জিক্যাল সুতার মার্কেট ভ্যালু ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিছু কিছু বিশেষ অপারেশনে এই সুতা ব্যবহার করা হয়। এ বছর চীনা বিজ্ঞানী লুয়ানের একটি গবেষণা আছে। তিনি সেখানে প্রমাণ করেছেন মাছের পটকা থেকে উৎপন্ন সুতা থেকে অধিক শক্তি সম্পন্ন এবং মাল্ট্রি ড্রাগ লোড করা যায়। এই সুতার এসিড রেজিস্টেন্স ক্ষমতাও অনেক বেশি। এই গুণাবলীর জন্য এই সুতা কম পিএইচ সম্পন্ন অর্গান যেমন পাকস্থলির অস্ত্রোপচার অথবা অ্যাকিলিস টেন্ডনের অপারেশান, যে ক্ষেত্রে সুতা একই সঙ্গে শক্ত ও ইলাস্টিক হতে হয়, সেখানে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কালো পোয়ার দাম মূলত তার বায়ুথলি বা পটকার কারণে। ৩০ কেজি ওজনের কালো পোয়ায় প্রায় ১ কেজির পটকা বা বায়ুথলি পাওয়া যায়। এই বায়ুথলিই বাহিরের দেশে রপ্তানি করা হয়। ইন্ডিয়ান গবেষকরা এর স্কিন থেকে জেলাটিন তৈরি করেছেন।
ড. দেবাশীষ সাহা বলেন, মাছের লিঙ্গের সঙ্গে এর দামের তারতম্য রয়েছে। যদি স্ত্রী মাছ হয় তাহলে তার দাম পুরুষ কালো পোপার চেয়ে অনেক কম। কেননা পুরুষ কালো পোয়ার বায়ুথলি বা পটকা বড় হয়। আমাদের দেশে এই মাছ নিয়ে গবেষণা তেমন হয়নি। তবে আমি মনে করি তরুণ গবেষকদের এ বিষয়ে গবেষণা করার অনেক উপাদান আছে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ নভেম্বর (মঙ্গলবার) কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনে আব্দুল গণি নামে এক জেলের জালে ধরা পড়া জোড়া কালো পোপা। মাছ দুটি সাড়ে আট লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাছ দুটির মধ্যে একটির ওজন ২৪ কেজি ৯০০ গ্রাম ও আরেকটির ওজন ৩০ কেজি ৩০০ গ্রাম। আব্দুল গণি প্রথমে ওই মাছের দাম তিনি ৬০ লাখ টাকা দাবি করেন। এতে মাছ দুটি বিক্রি না হওয়ায় পরে সাড়ে আট লাখ টাকায় বিক্রি করেন।