মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংকট বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় উদ্বেগ-উত্তেজনা ছড়ানো নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গেলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু দিন ধরে মিয়ানমার তাদের ভেতরের তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। এগুলো হলো- আরাকান আর্মি, ওয়া আর্মি ও কাচিন ইনডিপেন্ডেন্ট আর্মি। প্রায় দেড় দশক আগে তিন সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল। এটি 'নর্দান অ্যালায়েন্স' নামে পরিচিত।
সম্প্রতি নর্দান অ্যালায়েন্স নাম বদল করে 'ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স' রাখা হয়। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমার লড়াই শুরু করার পর চুক্তি অনুযায়ী ওয়া আর্মি ও কাচিন আর্মি আরাকানকে সহযোগিতা করে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলার মুখে তাদের অভ্যন্তরের সীমান্ত এলাকায় আরাকান আর্মি শক্তি সঞ্চয় করে। দেশের ভেতরের সশস্ত্র সংগঠনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে মিয়ানমার।
একটি হলো শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের উস্কানি দেওয়া। তুমব্রুতে শূন্যরেখায় স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৭ সালের পর থেকে চার হাজার ২৮০ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। মিয়ানমারের কৌশল হলো- সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লে শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা প্রভাবিত হবে। তারা পাল্টা হামলা করতে পারে। তখন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে দেশটি বলার সুযোগ পাবে- শূন্যরেখা থেকে মিয়ানমারকে লক্ষ্যবস্তু করছে তারা।
এ ছাড়া সীমান্তে উত্তাপ ছড়িয়ে নিজেদের ভেতরের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকে সীমান্ত এলাকায় অবৈধ বাণিজ্যের মূল নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিতে চায়। দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ আছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অসাধু কর্মকর্তারা সরাসরি ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িত। তবে রাখাইনে ধীরে ধীরে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়ায় ইয়াবাসহ অন্যান্য চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ সশস্ত্র সংগঠনটির কাছে হারানোর ভয়ও রয়েছে মিয়ানমারের জান্তাদের।
সশস্ত্র সংগঠনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে একাধিক দফায় মর্টার শেল এসে পড়া ও তাদের বিমান আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করা 'টেস্ট কেস' কিনা- তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পরামর্শ বিষেশজ্ঞদের। এমনকি শূন্যরেখার অধিকাংশ রোহিঙ্গা দীর্ঘ দিন থেকে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত- এমন অভিযোগও আছে। শূন্যরেখাকে অনেকে মাদক কারবারিদের 'ওয়্যার হাউস' ও 'বিশ্রামাগার' বলেও অভিহিত করেন। সেখানে মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কথা বলা যায়।
শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) শূন্যরেখা ছাড়তে দীর্ঘ দিন হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। গত শুক্রবার তারই অংশ হিসেবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বাহানা দেখিয়ে এ ক্যাম্প বরাবর মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। ক্যাম্পের নিরাপত্তা চেয়ে সোমবার জাতিসংঘ বরাবর খোলা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে শূন্যরেখায় ক্যাম্পে মানববন্ধনও করা হয়।
সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, রাখাইনজুড়ে আরাকান আর্মির যে সামরিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা, তাতে কিছুটা শঙ্কিত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। নতুন করে হামলার মুখে দেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত হাতছাড়া করতে চাইছে না তারা। বরং এখানে সামরিক প্রভাব আরও বাড়াতে চায়। সীমান্ত ঘিরে অবৈধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মি তাদের হাতেই রাখতে চায়। তবে কোনোভাবে আর আরাকান আর্মিকে সহ্য করতে পারছে না মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। যে কোনো মূল্যে তারা দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে এই দলের গেরিলাদের তাড়াতে চায়। তারই ফল সাম্প্রতিক উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও গোলাগুলি।
গত ১৩ আগস্ট থেকে এই পাল্টাপাল্টি চলছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে যেসব জায়গায় এখন সংঘর্ষ চলছে, তার মধ্যে আছে মংডু, বুথিডং, রাথিডং, ম্রাউক-উ (প্রাচীন আরাকানের রাজধানী) এবং পালেতোয়া। যুদ্ধের প্রধান ভরকেন্দ্র পালেতোয়া। এই জায়গাটা যদিও চীন প্রদেশে পড়েছে, তবে আরাকান আর্মি মনে করে, এটা উত্তর আরাকানেরই অংশ। পালেতোয়াকে আরাকান থেকে কেটে চীনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। খুকি চীনদের এলাকা হলেও রাখাইনদের ভাষাগত আধিপত্য প্রবল এখানে। যদিও এলাকায় রাখাইনরা সংখ্যালঘু।