বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বেতন এক লাখ ২০ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিকে মাসের বেতন হিসেবে এ পরিমাণ অর্থ প্রদানের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের খাবার, আবাসন, চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সেবা খাতের সব ধরনের ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করা হয়।
এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার এবং কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অতিথিদের পানীয় ও তামাকজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ট্যাক্স-ফ্রি কিনতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি অবসরে গেলেও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত স্টাফসহ অবসর সুবিধা পাবেন।
১৯৭৫ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রপতির বেতন ভাতা ও সুবিধাদি আইন’ প্রণয়ন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের দ্য প্রেসিডেন্টস (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) ১৯৭৫ পাস হয়। এরপর ১০ বার আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। এর আগেও এ সংক্রান্ত আইন থাকলেও সেটি কার্যকর নেই। তার বিস্তারিত সুবিধাদি সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না।
১৯৭৫ সালে প্রণীত আইনটি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সময়ে সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বেতন ভাতাটি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে এসব সংশোধনী হয়েছে। মূল আইনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—আইনটি প্রণয়নের সময়ে (১৯৭৫ সালে) রাষ্ট্রপতির বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫০০ টাকা। এরপর ১৯৮৭ সালে আড়াই হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা, ১৯৯২ সালে ১৫ হাজার টাকা, ১৯৯৮ সালে ২৩ হাজার টাকা, ২০০৫ সালে ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা, ২০০৯ সালে ৬১ হাজার ২০০ টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। অবশ্য বেতন বৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক থেকে দেড় বছর আগে ভূতাপেক্ষ হিসেবে কার্যকর ধরা হয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালের মে মাসে আইন সংশোধন করে যে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেটি কার্যকর ধরা হয়েছে ১ জুলাই ২০১৫ থেকে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি জাতীয় বেতন স্কেল প্রদানের সময়ের সঙ্গে মিল রেখেই এটি করা হয়েছে।
সর্বশেষ সংশোধিত দ্য প্রেসিডেন্টস (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) আইন ২০১৬ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে— বেতন ভাতা ছাড়াও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আরও অনেক সুবিধা ভোগ করেন। তিনি যে বেতন পান, সেটি সম্পূর্ণ আয়করমুক্ত। রাষ্ট্রপতির মাসে আড়াই হাজার টাকা ছুটি ভাতা পাবেন। এই টাকাও হবে আয়করমুক্ত।
রাষ্ট্রপতির জন্য সরকারি আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। এর আসবাবপত্রসহ সুসজ্জিতকরণ ও মেরামতের পুরোটাই সরকার বহন করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিজের বাড়ি বা ভিন্ন কোনও বাড়িতে অবস্থান করতে চাইলেও সেটিকে সুসজ্জিতসহ উপযুক্তকরণের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। রাষ্ট্রপতির বাসভবন সংশ্লিষ্ট রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কারের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে। অবশ্য আইনে এই সুযোগ থাকলেও জাতির পিতা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বসবাস করে আসছেন।
রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের খাবার খরচ সরকারকে বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাবুর্চি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় সরকারকে করতে হবে। আইনে পরিবারের সদস্য বলতে স্ত্রী-স্বামী, সন্তান, পিতা-মাতা ও অবিবাহিত ভাইবোনকে বোঝানো হয়েছে, যারা তার ওপর নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রপতির সরকারি আবাস্থলের টেলিফোন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সেবা খাতের ব্যয় সরকার বহন করবে। এসব বিল ট্যাক্সেরও আওতায় আসবে না। রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় যানবাহন সরকার নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্রপতির সব ধরনের সফর ও সফরকালীন অবস্থানের ব্যয়ও সরকার প্রদান করবে। পরিবহনের জ্বালানি সরকার বহন করবে এবং জ্বালানি হবে ট্যাক্সের আওতামুক্ত। রাষ্ট্রপতি ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেলওয়ে, বিমান ও নৌযানে সর্বোচ্চ সুবিধা সংবলিত আসন পাবেন।
বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে তার বার্ষিক ২৭ লাখ টাকা বিমা কাভারেজ সরকার প্রদান করবে।
রাষ্ট্রপতি বা তার পরিবারের সদস্য এবং সরকারি বেসরকারি অতিথিদের জন্য ব্যবহৃত তামাকজাত পণ্যের ওপর কোনও ট্যাক্স আরোপ করা যাবে না। এসব ব্যক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উৎপাদিত পানীয়ও ট্যাক্সের আওতামুক্ত থাকবে।রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনে তার প্রয়োজনীয় সব ধরনের অর্থও সরকার বহন করবে।
সরকারি কাজে বিদেশ সফরের সময়ে তার সব ধরনের খরচ সরকার প্রদান করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই খাতের ব্যয় সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বহন করা হয় বলে জানা গেছে।
আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আপ্যায়নের সুবিধাদি প্রাপ্য হন। বঙ্গভবনে দেশি-বিদেশি অতিথি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, ইফতার পার্টি, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, বুদ্ধপূর্ণিমা, দুর্গাপূজা, যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন, পহেলা বৈশাখ, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় সরকারের নির্ধারিত এ খাত থেকে বহন করা হয়। রাষ্ট্রপতি কোনও দেশি-বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়ন করলে বা তাদের কোনও ধরনের উপহার দিলে, তার ব্যয়ও সরকারি খাত থেকে করা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের আবাসস্থলেও সাধারণ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া দেশের হাসপাতালগুলোতে সরকারি খরচে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতি বছরে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয়ের জন্য স্বেচ্ছাধীন তহবিল পাবেন। সরকারের নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে এটি ব্যয় করবেন রাষ্ট্রপতি। স্বেচ্ছাধীন তহবিলের অর্থ থেকে দরিদ্র, অসচ্ছল, অসহায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। বাস্তব অবস্থা ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রয়োজনের নিরিখে এ খাতে বরাদ্দ রেখে দেশের সমস্যাগ্রস্ত দরিদ্র ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতির এ খাতের ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনও সরকারি অডিট হবে না।
এছাড়া ছয় মাস বা তার অধিক সময়কাল দায়িত্ব পালন শেষে রাষ্ট্রপতি অবসরে গেলেও বেতনের ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা পাবেন রাষ্ট্রপতি। এর বাইরেও অবসরকালে একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন অ্যাটেনডেন্টসহ সরকার নির্ধারিত দাফতরিক খরচ পাবেন। পাবেন মন্ত্রীর সমপরিমাণ চিকিৎসা খরচ। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে পাবেন বাহন ও সরকারি টেলিফোন। ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইনের আওতায় অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিদের এসব সুবিধার বিধান রয়েছে।