রমজান এলেই কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। খেজুর, ছোলা, চিনি, তেল ও পেঁয়াজের মতো পণ্যের মূল্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন এসব পণ্যের দাম।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকট, পণ্য আমদানি বন্ধসহ নানা অজুহাতে রমজানে চাহিদার শীর্ষে থাকা পণ্যগুলোর দাম কয়েক দফায় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রোজার আগে দাম আরও বাড়তে পারে— এমন কৌশলও গ্রহণ করেছে তারা। এদিকে, বাড়তি দামের বোঝা বইতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। এখনই এই অবস্থা, রমজানে কী হবে— সেই চিন্তায় দিশেহারা তারা।
সরকার বলছে, পুরো রমজান মাসে যে পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন দেশে বর্তমানে তার চেয়ে বেশি পণ্য মজুত আছে। শুধু তা-ই নয়, রোজার পণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি করতে বিশেষ সুবিধাও দিয়েছে।
তাহলে কেন বাড়ছে এসব পণ্যের দাম? ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ বলছে, পরিকল্পিতভাবে কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে দাম। কারসাজির অংশ হিসেবে তারা বলছেন, পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়েছে, তাই দাম বাড়তি। আরেক পক্ষ বলছে, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। সময় মতো আমদানি করতে না পারায় পণ্যের সংকট আছে, তাই দাম বাড়ছে।
অন্যদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, গত বছরের তুলনায় খেজুরের দাম এবার দ্বিগুণ হয়েছে। কিছুদিন আগে কেজিতে ছোলার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। নতুন করে আরেক দফা বাড়ানো হচ্ছে এ পণ্যের দাম। ইতোমধ্যে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। আবারও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সয়াবিন তেলের পর এখন পাম অয়েলের দামও বাড়ানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নিয়ন্ত্রণে থাকা পেঁয়াজের দাম নিয়েও ‘কারসাজি’র পরিকল্পনা করছেন কিছু ব্যবসায়ী।
ক্রেতাদের এসব অভিযোগ সত্য বলে মনে করছে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। রমজানে ভোক্তারা যাতে সুরক্ষা পান সেজন্য সরকারকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে তারা।
ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজানের মাঝামাঝি সময় দেখা যাবে এগুলোর দাম কমছে। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর পরিকল্পিতভাবে রমজানের পণ্যের দাম নিয়ে এক ধরনের খেলায় মাতেন ব্যবসায়ীরা। এবারও একই খেলা শুরু করেছেন তারা।’
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খেজুরের দাম গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছরের তুলনায় যা ৪৮ শতাংশ বেশি। চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ছোলার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। তেলের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। তবে, পেঁয়াজের বাজারে স্বস্তি রয়েছে।
অর্থাৎ রমজান উপলক্ষ্যে বেশির ভাগ পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় ৫ থেকে ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের বাজার মনিটরিং প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও একই চিত্র উঠে এসেছে।
দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের ‘কারসাজি’
কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে— অভিযোগ খুচরা ব্যবসায়ীদের। জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী বাকি বিল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোজার আগে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’।
‘তেল-চিনির দাম বাড়ানোর আগে যেসব ব্যবসায়ী এসব পণ্য আমদানি করেন, তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেন। কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে তারপর বিক্রি করেন।’ এই খুচরা ব্যবসায়ীর প্রশ্ন, ‘দুই দফায় চিনির দাম বাড়ানোর পরও এখনও কেন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত চিনি দিচ্ছে না?’
কারওয়ান বাজারে রোজার সদাই করতে আসা মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘তেল-চিনি বলেন বা খেজুর-ছোলা বলেন— সবকিছুর দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাজার করতে এসে মনে হয়, আমি আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুরে বাজার করতে এসেছি।’
মাঝারি মানের খেজুরের দাম ১০০ টাকা বাড়তি
প্রতিদিনের ইফতারে প্রয়োজনীয় উপাদান খেজুর। দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা এক লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসেই চাহিদা রয়েছে ৫০ হাজার টন। রাজধানীর বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, এ বছর প্রকারভেদে খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে। গত বছর যে খেজুর ১০০ টাকা ছিল সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। ২০০ টাকার খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকায়। মাঝারি মানের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজিতে।
খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১ মার্চ সবচেয়ে নিম্নমানের খেজুর বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা কেজি দরে। এক বছর আগে যা ছিল ১০০ টাকায়। মাঝারি মানের খেজুরের কেজি ছিল ৩৫০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ মাঝারি মানের খেজুরের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা।
প্যাকেট চিনিও মিলছে না বাজারে
রাজধানীর খোলা বাজারে বর্তমানে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজিতে। রমজান মাসে চিনির দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। তারপরও দাম কমছে না, উল্টো বাড়ছে। এমনকি প্যাকেটজাত চিনিও পাওয়া যাচ্ছে না।
টিসিবির মতে, বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। যা এক বছর আগে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পাম অয়েলের দামও বাড়তি
নানা সংকট দেখিয়ে কয়েক দফায় সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন রাজধানীর বাজারে বোতলজাত এক লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৭ থেকে ১৯০ টাকায়। এক বছর আগে যা ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা।
টিসিবির তথ্য মতে, খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক বছর আগে এসব তেল বিক্রি হয়েছে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। অন্যদিকে, পাম অয়েল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এক বছর আগে যা বিক্রি হয়েছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
আনিছুজ্জামান নামের এক ক্রেতা বলেন, কয়েক দফায় সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন বাড়ছে পাম অয়েলের দাম। এক সপ্তাহ আগেও ১৩০-১৩২ টাকা লিটারে বিক্রি হওয়া পাম অয়েল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। রোজা সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
ছোলার দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা
দেশে রোজার সময় ছোলার চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন। খোলা বাজারে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা দাম বেড়েছে।
টিসিবির তথ্য মতে, বর্তমানে বাজারে ছোলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। এক বছর আগে যা ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা দাম বেড়েছে।
পেঁয়াজের বাজারে স্বস্তি
রমজানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা চার লাখ টন। উৎপাদন ভালো হওয়ায় এবার গত বছরের চেয়ে পেঁয়াজের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে পেঁয়াজের বাজার স্বস্তিতে রয়েছে।
টিসিবির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এক বছর আগে যা বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। এক বছর আগে যা বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায়।