সাধারণ মানুষের জীবন এখন প্রযুক্তির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ফলে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন অনেক বিধিবিধান। এই তথ্য-প্রযুক্তিকে অনেক কল্যাণকর কাজে আমরা ব্যবহার করে থাকি। এর মাঝে একটি মোবাইলের মাধ্যমে কোরআন থেকে উপকৃত হওয়া। নিম্নে আমরা এসংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
কোরআনের অ্যাপস
গুগল প্লে-স্টোরে সার্চ করলেই কোরআনে কারিমের অনেক অ্যাপস পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই এসব অ্যাপস ব্যবহার করে থাকি। তবে একজন মুমিন হিসেবে এসব অ্যাপস ব্যবহারের আগে সতর্কতা কাম্য। কারণ এসব অ্যাপসের মাঝে এমন অনেক রয়েছে, যেগুলো ভুল-শুদ্ধ মিশ্রিত। সে জন্য যেকোনো অ্যাপস নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা ঠিক হবে না; বরং এ ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে যারা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ তাদের থেকে জেনে নেওয়া। এসব বিভ্রান্তি এড়াতে অভিজ্ঞ আলেম বা হাফেজ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া উচিত যে আমি যে অ্যাপস ব্যবহার করছি তা নির্ভুল আছে কি না? মুসলিম শরিফে এসেছে, ‘এই ইলম হচ্ছে দ্বিনের অংশ। তাই তোমরা তোমাদের দ্বিন কার কাছ থেকে গ্রহণ করছ তা খেয়াল রেখো। ’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬)
ডিভাইস দেখে কোরআন তিলাওয়াত করা
মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা অন্য যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইসে কোরআন তিলাওয়াত করা জায়েজ আছে। এ ক্ষেত্রে স্পর্শ করা ব্যতীত শুধু দেখে দেখে তিলাওয়াত করার জন্য অজু শর্ত নয়। অজু ছাড়াও তিলাওয়াত করা যাবে। তবে অজু করে তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। কারণ কোরআন তিলাওয়াত সর্বোত্তম জিকির। আর হাদিসে এসেছে, পবিত্র অবস্থা ব্যতীত রাসুল (সা.) জিকির করতে অপছন্দ করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৭)
তবে অজু ব্যতীত স্ক্রিনে কোরআনে কারিম স্পর্শ করার ব্যাপারে ওলামাদের দুটি মত পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ের অনেক আলেম বলেছেন যে কোরআনের স্ক্রিনের লেখা স্থায়ী নয়। এটি প্রতিচ্ছবির মতো। এ ছাড়া এর ওপর একটি আবরণও থাকে। তাই অজু ব্যতীত তা স্পর্শ করা যাবে। (আল-ইসলাম, সওয়াল-জাওয়াব, ফাতওয়া নম্বর : ১০৬৯৬৬১)
আবার কেউ বলেন, অজু ছাড়া স্ক্রিনে কোরআনে কারিম স্পর্শ করা যাবে না। কাগজে লেখা কোরআনে কারিম যেভাবে স্পর্শ করা জায়েজ নেই, তেমনিভাবে স্ক্রিনে লিপিবদ্ধ কোরআনও অজু ব্যতীত স্পর্শ করা জায়েজ নেই। তাঁরা বলেন, প্রয়োজনে স্ক্রিনের পাশের খালি জায়গায় আঙুল দেওয়ার সুযোগ আছে। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ইবনে হাজম (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমর ইবনে হাজমের কাছে যে পত্র লিখেছিলেন তাতে এটাও লিখিত ছিল যে পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কোরআনকে যেন কেউ স্পর্শ না করে। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস : ৪৫৫)
আর স্ক্রিনটাচ মোবাইলে প্লাস্টিক বা কাচের আবরণ যেহেতু মূল স্ক্রিনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত এবং তাতে হাতের স্পর্শও কার্যকর, তাই এ ক্ষেত্রে অজু ছাড়া গ্লাসের ওপর স্পর্শ করা হচ্ছে, লেখার ওপর নয়—এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়।
আর মতভেদপূর্ণ মাসআলায় সতর্কতা অবলম্বন করাই কাম্য। আর কোরআনুল কারিম যেহেতু শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও মর্যাদাপূর্ণ কিতাব। এ ক্ষেত্রে সতর্কতা হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করে তা স্পর্শ করা। পারতপক্ষে অজু ব্যতীত কোরআনে কারিম স্পর্শ না করাই ঈমানের দাবি।
অডিও কোরআন শোনা
মোবাইল বা মেমোরিতে তিলাওয়াত ডাউনলোড বা রেকর্ড করা কোরআন শোনা জায়েজ আছে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে যখন তিলাওয়াত চালানো হবে তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করতে হবে। অন্য কাজে ব্যস্ত থেকে তিলাওয়াতের রেকর্ড ছেড়ে দেওয়া শিষ্টাচারপরিপন্থী কাজ। কারণ কোরআন তিলাওয়াত শোনাও একটি স্বতন্ত্র আমল। সে জন্য তিলাওয়াত চালু করে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যার কারণে তিলাওয়াত শোনার ন্যূনতম হক আদায় হয় না। তাহলে সে ক্ষেত্রে রেকর্ড বন্ধ করে দেবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখো এবং নিশ্চুপ থাকো, যাতে তোমাদের ওপর রহমত হয়। ’ (সুরা : আল-আরাফ, আয়াত : ২০৪)
আল্লাহ তাআলা এখানে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করার কথা বলেছেন। এক হচ্ছে, স্বাভাবিক শোনা আরেক হচ্ছে, মনোযোগ সহকারে শোনা। দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
সেজদার আয়াত শোনার হুকুম
কোরআন তিলাওয়াত শোনার সময় যদি সেখানে কোনো সিজদার আয়াত পাঠ করা হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির তিলাওয়াতে সেজদা আদায় করা লাগবে না। তবে যদি কোনো ব্যক্তি লাইভ তিলাওয়াত শোনে, যা সরাসরি সম্প্রচার হয়; তাহলে সে ক্ষেত্রে সেজদার আয়াত শোনার দ্বারা তার ওপর তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ১/১৮৬)
মোবাইল সঙ্গে নিয়ে টয়লেটে যাওয়া
যে মোবাইলে কোরআনে কারিম রয়েছে সেই মোবাইল নিয়ে টয়লেটে যাওয়ার বিধান কী? এ ক্ষেত্রে মোবাইলের স্ক্রিনে যদি কোরআনে কারিম স্পষ্ট না থাকে, তাহলে সে মোবাইল নিয়ে টয়লেটে যেতে সমস্যা নেই। আর যদি মোবাইলের স্ক্রিনে কোরআনে কারিম ভাসমান থাকে তাহলে তা নিয়ে টয়লেটে যাওয়া যাবে না। (জামিয়া ইসলামিয়া বিন নুরি টাউন, ফাতওয়া নম্বর : ১৪৪১০৯২০১১৯৩)
মোবাইলে অন্য কাজ করা
তিলাওয়াত করার সময় মোবাইলে অন্য কোনো কাজ না করা। মোবাইলে অন্য কাজও করতে থাকা এবং মাঝেমধ্যে কোরআন তিলাওয়াত করা, এটি শিষ্টাচারপরিপন্থী। কারণ তিলাওয়াত, জিকির এসব কিছু মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। এসব একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য রাসুল (সা.) হতে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে। নাফে (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে ওমর (রা.) যখন কোরআন তিলাওয়াত করতেন তখন কোরআন তিলাওয়াত হতে অবসর না হয়ে কোনো কথা বলতেন না। (বুখারি, হাদিস : ৪৫২৬)