দুশ্চিন্তা ও হাতাশার কারণে মানুষের মাঝে এক ধরণের চাপ সৃষ্টি হয়। এটাই মানসিক। এ মানসিক চাপ উত্তরণে ইসলামে রয়েছে অনেক দিকনির্দেশনা, দোয়া ও আমল। যা মেনে চললে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়। মানসিক চাপ কমানোর এসব দিকনির্দেশনা, দোয়া ও আমলগুলো কী?
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা ও পেরেশানির কারণে প্রবল মানসিক চাপের সময় অনেক আমল করতেন। কোরআন তেলাওয়াত করতেন, নামাজ পড়তেন, আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করতেন। বিশেষ করে এ দোয়াটি বেশি পড়তেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল আঝযি ওয়াল কাসালি ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিঝাল।’
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা, পেরেশানি, অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, ঋণভার ও মানুষের প্রভাবাধীন হওয়া থেকে আশ্রয় চাই।’ (বুখারি ৬৩৬৯)
জীবনে চলার পথে দুঃখ-দুর্দশা আসতেই পারে। মানসিক টেনশনও হতে পারে। এতে আশাহত হওয়া কিংবা চাপ নেওয়া যাবে না। বরং আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে প্রতিটি পরিস্থিতিকে সুন্নত আমল ও দোয়ার মাধ্যমে জয় করে নিতে হবে। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা যাবে এমন কিছু কিছু বিশেষ আমল ও দোয়া তুলে ধরা হলো-
১. কোরআন তেলাওয়াত করা
মানুষের অন্তরকে কোরআন তেলাওয়াতই প্রফুল্ল করে তোলে। কেননা কোরআন তেলাওয়াত মুমিনের প্রফুল্লতার অনন্য উৎস। শুধু তাই নয়, কোরআন তেলাওয়াতে মুমিনের মনের প্রফুল্লতা ও মানসিক প্রশান্তি বাড়তে থাকে। কোরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ দুনিয়ার সব দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে থাকে মুক্ত।
২. নামাজে মনোযোগী হওয়া
যে কোনো চিন্তা-পেরেশানি ও বিপদ-মুসিবতের সময় নামাজের মাধ্যমেই প্রকৃত প্রশান্তি পাওয়া যায়। কেননা নামাজের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর সাহায্য পেয়ে থাকেন। তাই মানসিক প্রশান্তি পেতে নামাজে মনোযোগী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
> ’তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৪৫)
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ)
সাহাবায়ে কেরামও এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট থেকে অতি ছোট কোনো বিষয়ের জন্যও তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও নামাজের মাধ্যমে সমাধান করতেন।
৩. ক্ষমা প্রার্থনা করা
ছোট কিংবা বড়; যে কোনো মানসিক চাপ সামলাতে বেশি বেশি ইসতেগফারের বিকল্প নেই। যেসব কারণে মানুষ চাপে পড়ে, তন্মধ্যে অন্যায়-অপরাধ বেশি করা, অর্থকষ্টে থাকা, সন্তান-সন্তুতি না থাকা, জীবিকার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। এ সবের সমাধানে কোরআনের নির্দেশ হলো ইসতেগফার করা। এ ইসতেগফারেই মানুষ উল্লেখিত সমস্যা থেকে সামাধন খুঁজে পায় বলে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ। কোরআনে এসেছে-
> ‘অতপর বলেছি- তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা নুহ : আয়াত ১০-১২)
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইসতেগফার করবে, আল্লাহ তাআলা তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন। তার সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (আবু দাউদ)
৪. নবিজির প্রতি দরুদ পড়া
আল্লাহর রহমত পাওয়ার আমল দরুদ পড়া। আল্লাহর রহমত মানুষকে যাবতীয় মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখে। এটি আত্মপ্রশান্তি পাওয়ার সহজ উপায়ও বটে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পড়া এমন একটি ইবাদত যে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার ওপর অনেক বেশি দরুদ পড়তে চাই। আপনি বলে দেন আমি দরুদে কতটুকু সময় দেব?
তিনি বললেন- ’তুমি যতটুকু চাও! আমি বললাম- এক চতুর্থাংশ সময়? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও! যদি আরো বাড়াও তা তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম- অর্ধেক সময়? তিনি বললেন- তুমি যতটুকু সময় পড়তে পার, যদি এর চেয়ে আরো সময় বাড়াও তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম- তাহলে সময়ের দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন- তুমি যতটুকু চাও, যদি আরো বাড়াও তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম- সম্পূর্ণ সময় আমি আপনার ওপর দরুদ পড়ায় কাটিয়ে দেব। তখন তিনি বললেন- তাহলে এখন হতে তোমরা পেরেশানি দূর হওয়ার জন্য দরুদই যথেষ্ট এবং তোমার পাপের কাফফারার জন্য দরুদই যথেষ্ট।’ (তিরমিজি)
৫. তাকদিরে বিশ্বাস করা
সুখ-দুঃখ সব ক্ষেত্রেই মুমিন বান্দা তাকদিরের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আর দুঃখ-হতাশা, অভাব-অনটন, বিপদ-আপদে তাকদিরের উপর বিশ্বাস থাকলে কোনো মানুষই মানসিক চাপ অনুভব করে না। যে কোনো চাপের সময় আল্লাহর উপর ভরসা করে তাকদিরর উপর ছেড়ে দেওয়ায় রয়েছে মানসিক প্রশান্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
> ’আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা মোচন করতে পারে না। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ পরিবর্তন করারও কেউ নেই।’ (সুরা ইউনুস : আয়াত ১০৭)
> ‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় আসে আমি ইহা সংঘটিত করার আগেই ইহা লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহর পক্ষে ইহা খুবই সহজ।’ (সুরা হাদিদ : আয়াত ২২)
৬. আশাহত না হওয়া
হতাশা থেকে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। তাই বিপদ-আপদে হতাশ না হওয়াই ঈমানদারের কাজ। যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদ আসতে পারে এ মানসিকতা সব সময় পোষণ করা। ফলে তা মানুষকে বিপদে মানসিক চাপমুক্ত রাখে। কোরআনুল কারিমে এসব বিপদ-আপদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৬)
৭. পরকালের কথা স্মরণ করা
মৃত্যু যেমন মানুষের জীবনকে থামিয়ে দেয়, তেমনি মৃত্যু ও পরকালের চিন্তাও মানসিক চাপকে একেবারেই মিটিয়ে দেয়। পরকালের কঠিন পরিস্থিতির কথা স্মরণ রাখলে দুনিয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ করা হয় না। মানুষ থাকে মানসিক চাপমুক্ত। পরকালের তুলনায় দুনিয়ার বিপদ-আপদ একেবারেই নগন্য। আল্লাহ বলেন-
‘যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে।’ (সুরা নাযিআত : আয়াত ৪৬)
৮. আল্লাহর প্রতি ভরসা করা
মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে মহান আল্লাহর প্রতি ভরসা করা জরুরি। কেননা তিনিই বলেছেন- ‘যে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক : আয়াত ৩)
সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করতে জানে তার জন্য কোনো চিন্তা নেই। হাদিসে এসেছে-
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ (বুখারি)
৯. আল্লাহর কাছে দোয়া করা
মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। দোয়া বা প্রার্থনা করলে, কোনো কিছু চাইলে মহান আল্লাহ খুশি হন। না করলে বরং অসন্তুষ্ট হন। তবে দোয়ার ক্ষেত্রে হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে জানি, কোনো বিপদে পড়া লোক যদি তা পড়ে তবে আল্লাহ তাআলা সে বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে আমার ভাই (হজরত) ইউনুস (আলাইহিস সালাম)-এর দোয়া। তাহলো-
لَا اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كَنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ
উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমিন।’
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি)
এছাড়াও চিন্তা ও পেরেশানির সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল আঝযি ওয়াল কাসালি ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিঝাল।’
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা, পেরেশানি, অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, ঋণভার ও মানুষের প্রভাবাধীন হওয়া থেকে আশ্রয় চাই।’ (বুখারি ৬৩৬৯)
বর্তমান সময়ে মানসিক চাপে থাকেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কম-বেশি সবার মাঝেই মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থাকে। আর তা এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই উল্লেখিত আমলগুলো অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
আল্লাহ তাআলা মসুলিম উম্মাহসহ সবার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, কর্মক্ষেত্রের সব মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে উল্লেখিত আমলগুলো যথাযথভাবে করার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে মানসিক চাপমুক্ত জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।