যুগে যুগে যেসব রাজা বিশ্ব শাসন করেছেন তাদের অনেকেরই ছিল রসনা বিলাস। মোগল, গ্রীক কিংবা মিশরের সম্রাটদের বড় একটা অংশই ছিলেন ভোজনপ্রেমী। তাদের রসনা মেটাতে বিখ্যাত বাবুর্চিদের বানানো মুখরোচক খাবার বর্তমানেও সমান জনপ্রিয়। চলুন জেনে নেই...
মোগল সম্রাট
মোগলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে আসে পোলাও, বিরিয়ানি, কোফতা, সিঙাড়া, হালিম, সমুচা ইত্যাদি। ভেড়া, ছাগল, খাসির মাংসের খাবার ছিল তাদের নিত্যদিনের। অনেকে খেতেন নিরামিষ। বাদশাহ আকবর পান করতেন গঙ্গার পানি। আকবর সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ আহার করতেন। আবুল ফজলের মতে, কেবলমাত্র প্রাণী হত্যার জন্যই নয়, সম্রাট হয়তো পেটের কিছু সমস্যার কারণেও নিরামিষ খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাটের বাগানে সবজি চাষ হতো। সেই সবজি দিয়েই হতো রান্না। সবজি বাগানের গাছগুলোতে নিয়ম করে গোলাপজল দেওয়া হতো যাতে রান্নায় সুবাস ছড়ায়।
মোগল হেঁসেলে মুরগি রান্নার আগে কয়েকমাস ধরে আফগানী মুরগি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হতো। প্রাসাদসংলগ্ন খামারে প্রতিদিন মুরগিকে দানা খাওয়ানো হতো, দানাগুলোতে জাফরান ও গোলাপজল মেশানো থাকতো। এমনকি মুরগিদের গোলাপজলও পান করানো হতো। রোজ কস্তুরী মৃগের নাভীর তেল ও চন্দন তেল দিয়ে মুরগিগুলোকে মালিশ করানো হতো গায়ের আঁশটে গন্ধ দূর করার জন্য এবং সুস্বাদু, নরম, সুগন্ধী মাংসের জন্য। কাশ্মীরী পাচকরা রান্নায় পেঁয়াজ ও রসুন যোগ করা ছাড়াও স্থানীয় মোরগচূঁড়া গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল মেশাতো। ওই ফুল মেশানোর ফলে রান্না টকটকে লাল রঙের হতো।
আকবরের আমলে ‘কাবুলি’ নামে এক ধরনের বিরিয়ানি রান্নার চল শুরু হয়। ইরানি ভেড়ার মাংসের সঙ্গে বাংলার কালো ছোলা, শুকনো খুবানি (এপ্রিকট), কাঠবাদাম ও তুলসি পাতা যোগ করা হতো সেই রান্নায়।
মজলিসে সুরাহ পান করতেন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। গুজরাট ভ্রমণকালে তিনি খিচুড়ি খেয়ে এতোটাই আনন্দ পান যে, খিচুড়ির প্রতি তার আসক্তি জন্মে। এমনকি মদ্যপান ত্যাগ করার প্রচেষ্টায় এই খিচুড়ি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলা যায়।
সেই সময় রান্নার ঝোল সুস্বাদু ও ঘন করার জন্য দুধ, দুধের সর, দই মেশানো হতো। রান্নার পর সাজানোর জন্য ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হতো আর টাটকা রাখার জন্য সোনা এবং রুপার তবকে মোড়ানো হতো। মোগল আমলে রান্নায় দেওয়া হতো সুগন্ধি মশলা, বাদাম, শুষ্ক ফল, জাফরান, গোলাপ জল।
ঐতিহাসিকদের মতে, বাবরের সময় থেকেই মাটির উনুনে রান্না হতো। মাটির হাঁড়ি ভর্তি ভাত, মশলা, মাংস মাটির নিচে গরম গর্তে রাখা হতো। খাবার পরিবেশনের আগে তা বের করে দেওয়া হতো। বাবর ভারতবর্ষের সমুদ্রের নোনা জলের মাছ খেতে ভালোবাসতেন। সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবার তিনি মদ্যপান করতেন না।
আওরঙ্গজেব নিরামিষ আহার পছন্দ করতেন। আকবরের সময়ে পাঁচমেল ডাল, চাল, তুলসি পাতা, মুসুরডাল, শুকনো খুবানি, কাঠবাদাম ও দই দিয়ে বিরিয়ানি তৈরি হতো। তার সময়েও কাবুলি বিরিয়ানির কথা রুকৎ-ই-আলমগীরী বই থেকে জানা যায়। আওরঙ্গজেব আম খেতে ভালোবাসতেন। এমনকি পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাসকে তিনি আম পাঠাতেন উপহারস্বরূপ।
শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শিকার করতে ভালোবাসতেন এবং হরিণের মাংস খেতেন। এ ছাড়াও অন্যান্য খাবারের মধ্যে মুগ ডাল ছিল তার প্রিয়।
রোমান সম্রাট
রোমান সম্রাটদের প্রধান খাবার ছিল রুটি এবং স্যুপ। ডিম, মাংস, পনির ছিল তাদের পছন্দের অন্যতম। লেটুস পাতা, আইসক্রিম ছিল তাদের প্রিয় মিষ্টান্ন।
রোমার সম্রাটরা প্রায়ই নৈশভোজের আয়োজন করতেন। নৈশভোজের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন পদের খাবারের সঙ্গে পানীয়। সেসময় দুটি বিশেষ ধরনের মদ ছিল যেগুলো মূলত অভিজাতরাই পান করতেন, একটির নাম ‘ক্যালডা’ আর আরেকটি ‘মুলসুম’। ‘ক্যালডা’ ছিল শীতের রাতে নৈশভোজের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পানীয়। এই পানীয় অতিথিদের মাঝে গরম গরম পরিবেশন করা হতো। এটি বিভিন্ন মশলার সংমিশ্রণে তৈরি করা হতো। ‘মুলসুম’ ছিল মধু দিয়ে তৈরি। এটি রোমান সংস্কৃতিজুড়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। রোমান সম্রাটরা শূয়োরের মাংস পছন্দ করতেন।
গ্রীসের সম্রাট
প্রাচীন গ্রীসের রাজার ছিলেন শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাদের খাদ্যতালিকায় প্রধান ছিল রুটি এবং ওয়াইন। ঝলসানো গরুর মাংস, ভেড়ার রান, ছাগলের মাংস ছিল তাদের পছন্দের খাবার। মিষ্টান্নসহ ডুমুর, আপেল, জলপাই ছিল পছন্দের ফল। পনির থাকতো তাদের খাদ্যতালিকার শীর্ষে।
মিশরীয় সম্রাটরা
মিশরের সম্রাটদের অনেকেই আমিষ খেতেন না। পাতজুড়ে থাকতো বাহারী নিরামিষ। মাংস, স্যুপ, সালাদ ছিল অন্যতম প্রধান খাবার। সঙ্গে থাকতো নানা ধরনের তাজা ফল ও মিষ্টান্ন। মিশরীয় খাবারগুলোতে সাধারণ মাংস হলো কবুতর, মুরগি এবং মেষশাবক।