ছেলেরা সাফ শিরোপা জিতেছে ১৯ বছর। ঢাকায় জেতা ২০০৩ সালের সেই স্বাদ ভুলেই গেছে মানুষ! দেশের বাইরে শিরোপা জয় আরও চার বছর আগে, ১৯৯৯ সালে। সেবার জুয়েল রানা-আলফাজরা মিলে এভারেস্ট জিতেছিলেন। এরপর শুধু হতাশার গল্পই লিখেছে দেশের ফুটবল। মাঝের এই সময়ে দেশের নারী ফুটবলের অগ্রগতি চোখে পড়েছে।
সমস্যা হলো, উন্নতিটা এএফসি’র বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে স্পষ্ট হলেও কখনো তাতে লাগেনি সাফ শিরোপার রঙ। মোদ্দাকথা, বড় সাফল্য পায়নি সিনিয়র টিম।
২০১৬ সাফে প্রথমবারের মতো নারী সাফের ফাইনালে উঠেও মাথা নোয়াতে হয় ভারতের কাছে। এবার গ্রুপ ম্যাচে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের দর্প চূর্ণ করে তারা লাল-সবুজের বিস্ফোরণের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ নারী দল সামগ্রিক উন্নতি প্রতিষ্ঠা করলো কাঠমান্ডুর দ
একসময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী, তারাই হিমালয়ের পাদদেশে উড়ালো বিজয় কেতন।
সাবিনা-কৃষ্ণা-সানজিদাদের পথটা এতোটা মসৃণ ছিল না। ফাইনালের মাঠের মতোই কাদা-মাটিতে পিছলে পড়তে হয়েছে বারবার। সাবিনা-কৃষ্ণারা যতবার পড়েছেন, ততবারই অদম্য শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। জীবনে একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়েছে। সিঁড়ি মাড়াতে গিয়ে অনেক সতীর্থের পা হড়কে পড়ে যাওয়া দেখতে হয়েছে। সেখান থেকে উঠে শীর্ষ পর্যায়ে ছোট-বড় অনেক প্রাপ্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন তারা। যে পথে লেখা আছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া কলসিন্দুর থেকে নারী ফুটবলের নতুন গল্পের শুরু। যে গল্প পূর্ণতা পেয়েছে কাঠমান্ডুর দশরথে। ওই স্কুল থেকে আসা ১২-১৩ বছরের শিশু আঁখি খাতুন, কৃষ্ণা রানী, সানজিদা, মারিয়া মান্দারা ২০১৫ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতে।
এরপর তাদের ২০১৭ সালে ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। পরে পিঠে সাঁটা হয়েছে অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ সাফের চ্যাম্পিয়ন তকমা। ওরা জিততে জানে, ওরা লড়তে জানে। সানজিদার ভাষ্যে যে লড়াইয়ে আছে- বাবার মৃত্যুর গল্প, মায়ের শেষ সম্বল, বোনের গহনা বিক্রির গল্প। আছে অভাব-অনটন, পায়ে পরানো সমাজের নানান শিকল ভাঙার গল্প। আছে সামনের রক্তচক্ষুর ভয়ও। একটা সময়ে এসব মেয়ের কারণে বাবা-মায়েরাও অনেক কটু কথা শুনেছেন।
মেয়ে পুরুষদের মতো ফুটবল খেলে বলে একটা সময় বহু কটু কথা শুনেছেন নিলুফার মা বাছিরন আক্তার। উচ্ছ্বসিত এই মা বলেন, ‘আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় ভালো ছিল। সংসারে অনটনের মধ্যে কখনো খেলতে যেতে মানা করিনি। যদিও প্রতিবেশীরা টিপ্পনি কেটে বলতেন, মা হয়ে মেয়েকে খেলায় পাঠায়। তবুও আমি হাল ছাড়িনি। মানুষ যত খারাপ বলে বলুক, আমি ভেবেছি এর শেষ দেখে ছাড়বো। এখন ওইসব প্রতিবেশী আমাকে অভিনন্দন জানাতে বাড়ি আসছে।’ জোড়া গোল করে শিরোপা জেতানো কৃষ্ণা রানী সরকারের পথও ছিল কণ্টকাকীর্ণ। টাঙ্গাইলের উত্তর পাথুলিয়া গ্রামে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কৃষ্ণা রানী সরকারের। পৃথিবীর আলো দেখার পর কখনোই সুখের মুখ দেখেননি। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই দেখেছেন বাবাকে কষ্ট করতে। দর্জির কাজ করে কোনো রকমে সংসারের খরচ চালাতে হতো বাবাকে।
রান্নার চুলোয় গিয়ে দেখতেন ক্রন্দনরত মায়ের মুখ। অভাবের সংসার; ছোট ভাইকে নিয়ে ঠিকমতো খেতেও পেতেন না কৃষ্ণা। অর্ধাহার-অনাহারে দিনাতিপাত করেছেন। কিন্তু কোনো বাধাই দমাতে পারেনি তাকে। অদম্য ইচ্ছা শক্তি তার লক্ষ্য থেকে তাকে টলাতে পারেনি এক চুলও। প্রতিবেশীদের নানা কটূক্তি সহ্য করে আজ তিনি পরিণত হয়েছেন ১৬ কোটি মানুষের মাথার তাজে। ময়মনসিংহের ‘কলসিন্দুর’-এ বেড়ে আটজন আছেন এ দলে। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবিচল লক্ষ্য, অদম্য মনোবল, প্রবল ইচ্ছা আর দৃঢ়সংকল্পকে সঙ্গী করে তারা পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নপূরণের পথ।
এ দলের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলী আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তারের বাড়ি কলসিন্দুরে। ৪ গোল করা সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুরে। আঁখির সিরাজগঞ্জ, সাবিনা ও মাসুরা সাতক্ষীরা, কৃষ্ণা টাঙ্গাইল, মনিকা, রূপনা ও ঋতুপর্ণা রাঙ্গামাটির। নীলুফার ইয়াসমিনের বাড়ি কুষ্টিয়া। খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার সাত ভাইয়াপাড়া গ্রাম দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পেয়েছে আনাই মগিনি, আনুচিং মগিনি ও মনিকা চাকমার কল্যাণে।
এই বীরকন্যারাই ফুটবলে বাংলাদেশকে করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। সুবিধাবঞ্চিত এসব মেয়ের অতীত অনেকের জানা। এই মেয়েদের কল্যাণেই আজ অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। রাস্তা হয়েছে মারিয়া মান্দা-মনিকাদের গ্রামে। অথচ আধুনিক যুগে এসেও সাবিনা-কৃষ্ণারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে মাসিক বেতন পান মাত্র দশ হাজার টাকা! সেটাও আবার ক্যাটাগরি অনুযায়ী। কারো আট, কারো নয়, কারো দশ হাজার। কিন্তু এতেও তাদের মুখ থেকে কখনো আফসোস বা অভিযোগ বের হয়নি।
স্বল্প বেতনে তারা অধিকাংশই সন্তুষ্ট। এই টাকা দিয়েই তারা তাদের পরিবারের সংসারের খরচ চালাতে পারে। ছোট্ট ভাই-বোনের আবদার মেটাতে পারে। ছেলেদের মতো ক্লাব ফুটবলে এত এত টাকা আয়ের সুযোগ নেই সাবিনাদের। বসুন্ধরা কিংসের বদৌলতে গত দুই মৌসুমে যে টাকা আয় করেছে সেটাও আহামরি নয় বললেই চলে। যদিও এই মৌসুমে এখনো নারী লীগের খবর নেই।
এরপরেও টাকা-পয়সা নিয়ে মেয়েদের মধ্যে কখনো আক্ষেপ দেখা যায়নি। সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে উঠে আসা এসব মেয়ের মধ্যে ছিল জয়ের ক্ষুধা। যে ক্ষুধাই হিমালয়ের দেশ থেকে সেরা সাফল্য নিয়ে এসেছে দেশের জন্য। সময় বদলেছে, মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। আর্থিক, মানসিক বা সামাজিক; সবদিক থেকেই মেয়েদের নিশ্চয়তা প্রদানের সময় এসেছে।